একতাই শক্তি

 


অধ্যায় ১: অন্ধকার রাতের শুরু

রাত গভীর।
বাতাসে যেন অজানা শঙ্কার গন্ধ।
শহরের নির্জন রাস্তায় বাতি গুলো টিমটিম করছে। একটা-দুটা গাড়ি মাঝে মাঝে ছুটে যাচ্ছে, আর দূরে কোথাও ভেসে আসছে পুলিশের সাইরেনের কাটা কাটা শব্দ। মনে হচ্ছে, এই শহর কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে। অন্ধকারে যেন জমে আছে অপেক্ষা—এক বিস্ফোরণের।

গাইবান্দা সদরের  একটি পুরনো একতলা বাড়িতে তখন আলো জ্বলে আছে।
ভেতরে বসে আছেন সমীর খান, একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই বয়স, গায়ে হালকা চাদর, চোখে পুরু ফ্রেমের চশমা। হাতে ধরা একটা বই, কিন্তু চোখ সেখানেই আটকে নেই। বারবার জানালার দিকে তাকাচ্ছেন।

তাঁর স্ত্রী মাধুরী পাশে এসে বসলেন।
“তুমি কিছু বলছো না। রাতে বারবার উঠে জানালায় তাকাও কেন?”

সমীর ধীরে বললেন,
“মাথায় একটা চিন্তা আটকে গেছে। আজ স্কুল থেকে ফেরার পথে কিছু দেখেছি। ঠিক বুঝতে পারছি না—কিন্তু মন বলছে, এটা স্বাভাবিক নয়।”

মাধুরী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন,
“সেই ছেলেটা… তাপস? ওকে নিয়ে ভাবছো?”

সমীর মাথা নেড়ে বললেন,
“হ্যাঁ। ওর পরিবার ভালো। কিন্তু আজ ওকে দেখলাম একজন অপরিচিত লোকের কাছ থেকে ছোট একটা প্যাকেট নিচ্ছে। লুকিয়ে। চোখে ভয় ছিল।”

মাধুরী বললেন,
“তুমি সব সময় ভালো মনের মানুষ। কিন্তু সব কিছু নিয়ে মাথা ঘামালে আমাদের চলবে না। এখনকার দিনে ভালো থাকতে হলে অনেক কিছু না দেখার ভান করতে হয়।”

সমীর একটু হেসে বললেন,
“কিন্তু আমি শিক্ষক। অন্যায় দেখেও চুপ থাকলে, ছাত্রদের কী শেখাবো?”

এই কথাটার পর আর কিছু বলার থাকে না।
রাতটা কাটে অস্থিরতায়।


অধ্যায় ২: সন্দেহের বীজ

পরদিন স্কুলে গিয়ে তাপসকে ডেকে পাঠান সমীর।

“তাপস, তুমি গতকাল সন্ধ্যায় কোথায় ছিলে?”

তাপস কাঁপা কণ্ঠে বলে,
“স্যার… আমি… আমি দোকানে গিয়েছিলাম।”

সমীর সরাসরি বলেন,
“আমি তোমাকে দেখেছি একজন লোকের কাছ থেকে কিছু নিতে। তুমি ভয় পেয়েছিলে। বলো সত্যি কথা।”

তাপস কিছুক্ষণ চুপ থেকে মাথা নিচু করে ফেলে।
“স্যার, আমি বলবো। কিন্তু দয়া করে কাউকে বলবেন না। ওরা খুব খারাপ লোক। আমায় ভয় দেখিয়ে ওসব প্যাকেট নিতে বাধ্য করেছে।”

সমীরের মুখ থমথমে হয়ে যায়।
তিনি গম্ভীর গলায় বলেন,
“ওরা কারা? তোমার সঙ্গে আর কে কে জড়িত?”

তাপস মুখে আঙুল চেপে ধরে—“স্যার, ওরা বলে, যদি কারও কাছে কিছু বলি, তাহলে আমার মা-বাবাকে মেরে ফেলবে।”

সমীর চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন।
তারপর বলেন,
“তুমি চুপ থাকো, কিন্তু আমি নয়। আমি এটা মেনে নিতে পারবো না।”

সেদিনই স্কুল ছুটির পর থানায় যান সমীর।
ডায়েরি করেন, পুরো ঘটনা জানান ইন্সপেক্টর আকরামকে।
আকরাম মনোযোগ দিয়ে শোনেন, বলেন—
“স্যার, আমরা খোঁজ নেব। কিন্তু সাবধান থাকবেন। এই চক্রগুলো খুব বিপজ্জনক।”


অধ্যায় ৩: সংঘাত ও সাহসের শুরু

দিন কয়েকের মধ্যেই অদ্ভুত কিছু ঘটতে শুরু করে।
সমীর লক্ষ্য করেন, প্রতিদিন একটি কালো গাড়ি তাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়।

একদিন সন্ধ্যায়, মাধুরী ঘরের পর্দা সরিয়ে দেখলেন, সেই গাড়িটি আবার এসেছে। তার ভিতরে কয়েকজন অচেনা লোক। চোখে সানগ্লাস, গায়ের গড়ন ভারী। হঠাৎই বাড়ির গেটে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়।

মাধুরী চিৎকার করে ওঠেন—“সমীর! দরজা বন্ধ করো!”
সে সময় সমীর বই পড়ছিলেন। উঠে এসে দরজা আটকে দেন।
লোকগুলো দরজায় ধাক্কা দিতে থাকে।

মাধুরী পেছনের দরজা দিয়ে রাহুল আর রিয়াকে বের করে দেন—
“চলো, পাশের বাড়িতে যাও। কাউকে ডাকো! ভয় পেয়ো না!”

ভেতরে ঢুকে পড়ে মুখোশধারী তিনজন।
তারা সমীরকে ধরে ফেলে, গলায় ছুরি ধরে বলে—

“পুলিশে আবার খবর দিলে, তোমার বাচ্চাগুলোকে খুঁজে পাবে না।”

সমীর ঠাণ্ডা গলায় বলেন,
“তোমরা জানো না, কাকে ভয় দেখাতে এসেছো। একজন শিক্ষক কোনোদিন অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করে না।”

বাইরে রাহুল-রিয়া তখন ছুটে যাচ্ছে প্রতিবেশীদের বাড়িতে।
টর্চলাইট, মোবাইল, লাঠি হাতে জড়ো হচ্ছে প্রতিবেশীরা।
কারও মুখে ভয়, কারও চোখে রাগ।





অধ্যায় ৪: প্রতিবেশীদের প্রতিরোধ

সমীর যখন মুখোশধারীদের চোখে চোখ রাখছেন, তখন বাড়ির বাইরে অন্যরকম উত্তেজনা।
রাহুল আর রিয়া দৌড়ে পাশের বাড়িতে গেছেন। প্রথমে দু-তিনজন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকেন, তারপর রাহুল বলে উঠল,
“ওরা বাবাকে মারবে! দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন!”

বয়স্ক সিরাজ কাকু বললেন,
“চলো, একসাথে যাই। কোনো বাড়ির ভেতর ঢুকে এমন করে শাসানো—এটা তো সোজা কথা নয়।”

শুধু কাকু নন, আরও কয়েকজন প্রতিবেশী নিজেদের হাতের কাছে যা পেল—লাঠি, রড, টর্চলাইট—সব নিয়ে রওনা হলেন।

রাহুল মোবাইল ফোনে আবার পুলিশকে ফোন দিল।
এইবার ঠিক ঠিক লোকেশন দিয়ে বলল—গাইবান্দা সদরের,নূরের চালা, ১৬ নম্বর বাড়ি, লোক ঢুকে পড়েছে। দ্রুত আসুন!”

বাড়ির সামনে লোকজন জড়ো হতে শুরু করল।
ভেতরের চেঁচামেচি শুনে কেউ কেউ ভিডিও করতেও লাগল, কারণ কেউ বিশ্বাসই করতে পারছিল না—এক শিক্ষক পরিবার এত বড় বিপদের মুখে পড়েছে।

ভেতরে সমীর বললেন,
“আমার ছেলে এখন বাইরে। সে চুপচাপ বসে থাকবে না। তোমাদের দিন শেষ।”

এক মুখোশধারী ঠাটিয়ে একটা চড় মারল সমীরকে—
“বেশি কথা বললে, চিরদিনের মতো চুপ করিয়ে  দেব।”

ঠিক সেই সময় বাইরে থেকে জোরে চিৎকার এল—
“তোমরা ঘিরে ধরো! কেউ পালাতে পারবে না!”

আলোর ঝলকানি, লাঠির ঠকঠক শব্দ, চিৎকার—সব মিলে এক বিশৃঙ্খল দৃশ্য তৈরি হল।
মুখোশধারীরা বুঝে গেল, তাদের আর সময় নেই।

বাড়ির দরজার সামনে ভাঙা টর্চলাইটের আলোয় একজন অপরাধী পালাতে গিয়েও ধরা পড়ে যায়।
একজন প্রতিবেশী, ফারুক শেখ, বললেন—“তোমরা শিক্ষক পরিবারকে ভয় দেখাতে এসেছো? তোমাদের শিক্ষা এখন শুরু হবে।”

আরও কিছুক্ষণ পর, ভোঁ-ভোঁ করে পুলিশের গাড়ি ঢুকে পড়ে গলিতে।
দুই দিক থেকে লোক ঘিরে ফেলে বাড়িটিকে।
মুখোশধারীদের হাতকড়া পরানো হয়।
পুলিশ অফিসার আকরাম  এসে বলেন—
“স্যার, আপনি যেমন বলেছিলেন, এরা শুধু ভয় দেখায় না, ভয় দিয়েই চালায় পুরো মাদক ব্যবসা।”




 অধ্যায় ৫: পুলিশের অভিযান ও চক্রের ফাঁস

গ্রেপ্তার হওয়া লোকদের জেরা করে জানা গেল চাঞ্চল্যকর তথ্য।
এই লোকগুলো একটি স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার ছত্রছায়ায় কাজ করত।
তারা স্কুল-কলেজের ছাত্রদের ভয় দেখিয়ে মাদক পরিবহন করত।
তাপস ও আরও কয়েকজন ছেলেমেয়ে ছিল তাদের লক্ষ্যে।

পুলিশ যায় শহরের এক বস্তি এলাকার একটি পুরনো টিনের ঘরে—সেখানে পায় মাদকের গুদামঘর।
সেখানে একটি ছোট নোটবুকে নাম, তারিখ, প্যাকেটের ধরণ, স্কুলের নাম পর্যন্ত লেখা।
যদিও এটা জব্দ করা যায়, তবুও একজন অফিসার বলেন—
“সাবধান, এদের মাথাগুলো এখনো ধরা পড়েনি। মামলাটা সঠিকভাবে লড়তে হবে।”

সমীর সাহস করে বলেন,
“যত দূরই যেতে হোক, আমি ও আমার পরিবার এই মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত পিছু হটবো না।”


 অধ্যায় ৬: মামলা শুরু—প্রথম সাক্ষী

পুলিশ এফ আই আর ও চার্জ শীতের কপি আদালতে দাখিল করলো , কয়েকটি তারিখ যাওয়ার পর আদালত চার্জ গঠনের দিন ধার্য  করলো  এর মধ্যে ৩ মাস গত হয়ে গেলো। আমাদের দেশের মামলা মোকদ্দমার এই এক হাল , তারিখ আর তারিখ সময় পার আর সময় পার। এর মধ্যে আসামিরা ক্রয় করে বা ভয় ভীতি দেখিয়ে সাক্ষীদের বেশ করে নেয় আর আদালতের নানা ফেঁকড়ার কারণে অনেকেই এর থেকে দূরে থাকতে চায়। কিন্তু এখানে তা হলোনা কারণ সমীর খান একজন শিক্ষক  এবং সবার কাছে একজন ন্যায়ের  প্রতীক।  

 বিপুল নিরাপত্তা। সাংবাদিক, আইনজীবী, পুলিশ, সাধারণ মানুষ—সবাই কোর্টরুমের বাইরে।

কেসের নাম: "স্টেট বনাম লিটন তরফদার  ও অন্যান্য"
প্রথম সাক্ষী: সমীর খান

জজ সাহেব আসন গ্রহণ করতেই গম্ভীর গলায় বলেন,
“আজকের মামলায় আমরা প্রথমে অভিযোগকারীর বয়ান শুনবো।”

অভিযোগকারীর উকিল উঠে দাঁড়ান—
“সমীর খান একজন স্কুল শিক্ষক। ইনি সাহসিকতার সঙ্গে একটি অপরাধচক্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন। এখন তাঁর বয়ান শুনতে চাই।”

সমীর উঠে দাঁড়ান।
আদালতের বাতাস যেন ভারী হয়ে ওঠে।

তিনি বলেন—
“আমি সেই রাতের কথা ভুলতে পারি না। যখন আমার বাড়িতে তিনজন লোক ঢুকে আমার পরিবারের প্রাণনাশের হুমকি দেয়, কারণ আমি পুলিশকে সত্য জানিয়ে দিয়েছিলাম। একজন শিক্ষক হিসেবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আমার দায়িত্ব। আমি তা পালন করেছি।”

বিচারক মাথা নেড়ে বলেন,
“আপনার সাহসকে সম্মান করি। কিন্তু আদালতে সত্য প্রমাণ হতে হয় সাক্ষ্য দিয়ে।”

ডিফেন্সের উকিল তখন প্রশ্ন করেন—
“আপনার কি প্রমাণ আছে, অভিযুক্তরাই সেই রাতে আপনার বাড়িতে ঢুকেছিল?”
সমীর বলেন,
“আমি তাদের সরাসরি দেখেছি। আমার স্ত্রীও ছিলেন, এবং প্রতিবেশীরাও। তারা সবাই আজ এখানে।”

আদালত চুপ।
বিচারক বলেন—
“সাক্ষ্য গ্রহণ চলবে। পরবর্তী দিনে আমরা শুনবো অভিযুক্তদের বক্তব্য ও প্রতিরক্ষা।”



 অধ্যায় ৭: হুমকির ছায়া

আদালতে প্রথম শুনানির পরে শহরের কুচক্রী মহল একেবারে নড়ে বসে।
সাংবাদিকরা এখন সমীর খানকে নিয়ে রিপোর্ট করছে।
একটি স্থানীয় পত্রিকায় হেডলাইন বের হয়—
“শিক্ষক পরিবারের সাহস, মাফিয়ার মুখোশ খুলে দিলেন সমীর খান”

তবে সব ভালোবাসা সঙ্গে করে আনলো ভয়ও।
মাধুরী একদিন বাজার থেকে ফেরার পথে দেখেন, দুই ছেলেমানুষ পিছনে আসছে।
একজন মুখের নিচে হাত রাখে, আরেকজন বলে ওঠে—
“ভেবো না আমরা ভুলে গেছি। সময় মতো হিসাব হবে।”

মাধুরী কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে বলেন,
“সমীর, আমাদের ওপর নজর রাখা হচ্ছে।”

সমীর জানে—এই লড়াই এখন ব্যক্তিগত।
তিনি পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তাদের অনুরোধে একটি সাধারণ নিরাপত্তা টিম বাড়ির আশেপাশে মোতায়েন করা হয়।

এক রাতে রাহুল বলে ওঠে,
“বাবা, আমি আর ভয়ে পালাতে পারবো না। তুমি যা করেছো, সেটা আমার চোখ খুলে দিয়েছে।”

সমীর মাথায় হাত রেখে বলেন,
“তোমাদের সত্যি জানাটা দরকার ছিল। তবে ভয় নয়, সাহসকে সঙ্গে রাখো।”


 অধ্যায় ৮: রাহুল ও রিয়ার জবানবন্দি

দ্বিতীয় শুনানির দিন।
আদালত এখন শিশুদের সাক্ষ্য নিতে রাজি হয়।

প্রথমে রাহুল উঠে দাঁড়ায়।
তার বয়স মাত্র ১৬। কিন্তু মুখে এখন ভয় নেই, আছে দৃঢ়তা।

উকিল প্রশ্ন করেন,
“ঘটনার রাতে তুমি কী দেখেছিলে?”

রাহুল বলে,
“আমি ছাদের উপর থেকে দেখছিলাম। আমার বাবা-মা ভয় পাচ্ছিলেন না, অথচ ভিতরে ঢুকেছে তিনজন লোক। আমি পুলিশে ফোন করি। আমি প্রতিবেশীদের ডাকি। আমি ভয় পেয়েছিলাম, কিন্তু চুপ করে থাকিনি।”

বিচারকের চোখে ভিন্ন এক প্রশংসা।

পরবর্তী সাক্ষী—রিয়া। বয়স ১২।
কিন্তু সে এক নিঃসঙ্কোচ কণ্ঠে বলে,
“আমার মা আমাকে পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে পাঠিয়েছিলেন। তখনই আমি বুঝি, কিছু খারাপ হচ্ছে। আমার ভাইয়ের সঙ্গে আমি সাহায্য চেয়েছি সবার কাছে। এটা আমাদের পরিবারের জন্য লড়াই।”

ডিফেন্স উকিল চেষ্টাও করে তাদের জেরা করতে।
জিজ্ঞেস করে,
“তোমরা কীভাবে জানো ওই লোকগুলোই অপরাধী ছিল?”

রিয়া বলে,
“ওরা মুখ ঢেকেছিল। কিন্তু একজনের জামায় রক্তের দাগ ছিল। পরে পুলিশ যখন ধরে, সেই জামাটাই দেখি।”

আদালত স্তব্ধ।
রাহুল-রিয়া এখন শুধু শিশু নয়, সাক্ষ্য হয়ে উঠেছে।


 অধ্যায় ৯: তাপসের নাটকীয় স্বীকারোক্তি

তৃতীয় শুনানির দিন আদালতে হাজির করা হয় তাপসকে, যে এই কাহিনীর গোড়া।

সে প্রথমে চুপচাপ থাকে। তারপর জজ সাহেব বলেন,
“যদি সত্য বলো, নিজেকে মুক্ত করতে পারবে কিন্তু মিথ্যা বললে তুমি নিজেও অপরাধী হয়ে যাবে।”

তাপস কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থাকে। তারপর বলে—
“স্যার, আমি প্রথমে ভেবেছিলাম, এটা কেবল একটা প্যাকেট দেওয়া—ছোট কাজ। কিন্তু তারপর আমাকে ভয় দেখানো হয়। আমার মাকে নিয়ে হুমকি দেয়। তখন আমি বাধ্য হয়ে আরও ছেলেদের যুক্ত করি। আমি জানতাম এটা ভুল, কিন্তু সাহস পাইনি।”

অভিযোগকারীর উকিল বলেন,
“তুমি কি অভিযুক্ত লিটন তরফদারকে চিনো?”

তাপস চোখ তুলে দেখে এবং সোজা আঙুল তোলে,
“ওই লোকটাই সব চালায়। স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে ছেলে বাছত, তারপর ভয় দেখিয়ে প্যাকেট দিত।”

আদালতে চাপা গুঞ্জন।
ডিফেন্স উকিল ওঠে—“আপনার প্রমাণ আছে?”

তাপস কাঁপা কণ্ঠে পকেট থেকে একটি ছোট চিরকুট বের করে দেয়—
সেখানে লেখা আছে,
“SK স্কুল 9am, Rahul – 2pkt, Deep – 1pkt”
এই লেখার সঙ্গে লজিস্টিক বইয়ের মিল পাওয়া যায়।

এটা আদালতের পক্ষে একটি বড় মোড়।



 অধ্যায় ১০: যুক্তি ও পাল্টা যুক্তির লড়াই—আদালতে উকিলদের যুদ্ধ

এখন আদালতের ভেতর জোর গুঞ্জন।
একটি ছোট কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মামলা।
সমীর খান বনাম লিটন তরফদার ও তার চক্র।
দুই পক্ষের উকিলের চোখে চ্যালেঞ্জ, ভাষায় তীব্রতা।
এই যুদ্ধ এখন কেবল বাস্তবতা নয়—এটা সাহস, ন্যায় এবং ক্ষমতার যুদ্ধ।

অভিযোগকারী উকিল প্রথমে দাঁড়িয়ে বলেন,
“স্যার, এখানে যা ঘটেছে, তা শুধু একটি ব্যক্তিগত আক্রমণ নয়, পুরো সমাজের অশান্তির প্রতিফলন। আজ এই কোর্ট যদি সঠিক বিচার না দেয়, কাল আমাদের শহরের প্রতিটি কোণে একই ঘটনা ঘটতে পারে। এক শিক্ষকের সাহস আজ আমাদের ভবিষ্যত রক্ষা করেছে।”

ডিফেন্স উকিল একটি পদক্ষেপ নেন—
“এটা ভুল সিদ্ধান্ত, স্যার। উনি বলছেন, এই সবার পেছনে ‘রাজনৈতিক চক্র’ আছে, কিন্তু প্রমাণ কোথায়? কি-সত্য আমাদের জানানো হচ্ছে—তাপসের এমন ভয়াবহ স্বীকারোক্তি কী বিশ্বাসযোগ্য?”

অভিযোগকারী উকিল পাল্টা যুক্তি দেন,
“আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। তাপসের স্বীকারোক্তি এবং অন্যান্য সাক্ষ্য আমাদের পাশে। এবং পুরো পুলিশ রিপোর্ট যা বলছে, তা উনি মিথ্যা প্রমাণের চেষ্টাও করতে পারেন, কিন্তু দয়া করে এই সমাজকে রক্ষা করুন!”

আদালতে উত্তেজনা বাড়তে থাকে। বিচারক কিছুক্ষণ স্তব্ধ থাকেন, এরপর বলেন—
“কোর্ট এই মুহূর্তে সমস্ত প্রমাণ শুনবে এবং বিচার করবে। প্রত্যেকের সঠিক ও ন্যায্য বিচার নিশ্চিত করতে হবে।”

ডিফেন্স উকিল দ্রুত বললেন,
“স্যার, সঠিক তদন্ত ছাড়া একটা বাড়ির ওপর ভয়ানক আক্রমণ এবং অভিযোগও হতে পারে। আমাদের অবশ্যই বিচারটা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

এরপর আদালত কয়েকদিন বিরতি দেয়।


 অধ্যায় ১১: শেষ সাক্ষ্য ও জজের রায়

এবার আদালতে পৌঁছানোর পালা—শেষ সাক্ষ্য।
সমীরের শেষ সাক্ষ্য নেওয়া হচ্ছে। তার কথা শেষ হলে, আদালত সোজা তাকিয়ে থাকে।

“স্যার, আপনি নিশ্চিত যে, আপনার পরিবারকে ভয় দেখানো হয়েছে এবং আপনি প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন?”
জজের প্রশ্নের উত্তরে সমীর বলেন,
“আমি নিশ্চিত। আমি জানি, আমি যদি ভয় পেতাম, তা হলে আমাদের কী পরিস্থিতি হতে পারতো!”

পুলিশের রিপোর্ট এবং তাপসের স্বীকারোক্তির পর, সমাজের বিশেষজ্ঞও আসেন সাক্ষী হিসেবে।
সব প্রমাণের শেষে, উকিলরা শুদ্ধভাবে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরেন।
আর এখন, আদালতের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পালা।

এদিন বিকেলে, আদালত চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছে।
বিশাল গুমোট বাতাসে, আদালতের দরজা খুলে বিচারক মঞ্চে উঠে এসে ঘোষণা করেন—
“বিচারই হতে হবে। এখানে কোনোভাবেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। লিটন তরফদার এবং তার চক্রের সদস্যরা দোষী সাব্যস্ত।”




 অধ্যায় ১২: এক নতুন সকাল—সমীর খানের পরিবারের শক্তি

রায় শোনার পর, সমীর খান পরিবারের সবাই একে অপরকে জড়িয়ে ধরেন।
এটা তাদের সংগ্রামের জয়—নির্যাতিতের ন্যায়।
কিন্তু জানেন, তাদের লড়াই শেষ হয়নি—এটি একটি নতুন শুরু।

সেই রাতেই সমীর বলেন,
“এই যাত্রা শেষ নয়। আজ আমরা শুধু নিজেদের জন্য নয়, সমাজের জন্যেও দাঁড়িয়েছি। আমাদের সাহসই আমাদের শক্তি।”

একটি প্রতিবাদী শিক্ষকদের আন্দোলন শুরুর জন্যও পরিকল্পনা করতে থাকেন সমীর।
তিনি জানতেন, এই জয় শুধুই তার নয়—এটি প্রতিটি সাধারণ মানুষের জয়।
তাদের পরিবারের প্রতিরোধ তাদের শক্তি, আর সেই শক্তিই এখন সমাজে নতুন আলো এনে দেবে।

নতুন দিনের সূর্য উঠল।
সমীরের পরিবারকে আর কেউ সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন ভাববে না।
তারা জানে, একতার শক্তি সব কিছু জয় করতে পারে।


সমাপ্ত 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url