জীবন একটা স্মৃতির জাহাজ
নিত্যকার কর্মময় দিনের মতো একদিন শন্ত খান অফিসে যাওঘার সময় ছেলেকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পৌছে দেওয়ার সময় একটি ১২০০ ভোল্টের ঝটকার সম্মুখীন হলো। তার ছেলের বয়সী ছেলে সহ একজন মহিলা দাড়িয়ে। কীজেন অজানা মোহে তার দিকে তার দিকে তাকালাম। আর সেই ১২০০ ভোল্টের ঝটকার সম্মুখীন। আরে এতো রেহানা, আজ ১০ বছর পরে তার সাথ দেখা। দশ বছর তাকে দেখিনি। শান্ত অনেক কষ্টে তাকে আড়াল করে অফিসে চলে গেল। অফিস আজ কর্মহীন। গতকাল একটা জটিল এসাইনমেন্ট শেষ হয়েছে, তাই আজ শান্ত ফ্রি।
না আসলেও চলতো অফিসে।
শুবর্ণাও অফিসে চলে গিয়েছে। মনের মধ্যে মনের মধ্যে অতীতের যে ঝড় উঠেছে তা বাসার খাটে শুয়ে পার করলেই ভালো হতে। হায়রে সময়, হায়রে জীবন।
২
বর্ষার সময়। নদী তখন পূর্ণ যৌবনে। সবুজ ধানের ক্ষেতে বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ মিশে আছে নদীর ঢেউয়ের সাথে। এমনই এক অপরাহ্নে বরিশালগামী লঞ্চ "শুভযাত্রা" কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে ছেড়ে দিল। এটি সাধারণ কোনো লঞ্চ নয়, বেশ সম্ভ্রান্ত, সাজানো-গোছানো। ভেতরে ঝকঝকে আসন, ওপরে ডেকে মৃদু বাতাসে বেলি ফুলের মিষ্টি গন্ধ ছড়াচ্ছে। লঞ্চে যাত্রা শুরু হলো, আর নদীর বুক চিরে চলা এই লঞ্চের গতি যেন এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল।
লঞ্চে অনেক রকম মানুষ। কেউ ব্যবসায়ী, কেউ শিক্ষার্থী, কেউ পরিবারের সঙ্গে বেড়াতে যাচ্ছে। ভিন্নতা আর বৈচিত্র্যের মাঝেই শান্ত খান উঠল। শান্ত একজন স্বল্পভাষী, উচ্চশিক্ষিত যুবক। পেশায় প্রকৌশলী। বেশ কিছুদিন ঢাকায় কর্মরত থেকে বরিশালে নতুন প্রকল্পের কাজে যাচ্ছে। স্বপ্নভরা চোখ আর নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস ছিল তার সবসময়ের সঙ্গী।
আর তখনই রেহানার প্রবেশ। রেহানা একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। বাবার ইচ্ছায় বরিশালে পারিবারিক কাজে যাচ্ছিল সে। ভেতরে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের মানুষের চোখ তার দিকে চলে যায়। বুদ্ধিমত্তা আর মায়াময় হাসি তার সবচেয়ে বড় গুণ। লঞ্চের ডেকে এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ একটি বাচ্চা ছুটে এসে তার হাত থেকে পানির বোতল ফেলে দেয়। সেটা তোলা নিয়েই শুরু হয় শান্তর সঙ্গে পরিচয়।
"আপনার বোতল," শান্ত মৃদু হাসি দিয়ে বলল।
রেহানা কিছুটা অপ্রস্তুত হলেও ধন্যবাদ জানালো। ছোট্ট এই কথোপকথনের পর হয়তো কিছু বলার ছিল না, কিন্তু প্রকৃতি যেন তাদের আবারও একত্রিত করতে চায়। মেঘের গর্জনে বিদ্যুৎ চমকানো শুরু হলো। বৃষ্টি ঝেঁপে এল। যাত্রীরা ভেতরে ঢুকে গেল, আর শান্ত ও রেহানা দুজনেই পাশে দাঁড়িয়ে ভিজে যেতে লাগল। রেহানা ছাতা খুলতে গেলে শান্ত তার সহায়তা করল। এতটুকুতেই শুরু হয় এক চোরাস্রোতের মতো অনুভূতির যাত্রা।
৩
রাতের আঁধার নামার সঙ্গে সঙ্গে লঞ্চে আলো জ্বলতে থাকে। খাবারের ব্যবস্থা চলছে। কিন্তু তখনই ঘটে এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা—হঠাৎ করে লঞ্চের ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দেয়। লঞ্চের ম্যানেজার জানান যে তারা কিছুক্ষণের জন্য এখানে থামবে। যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে, কিন্তু শান্ত ধীরস্থিরভাবে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করে। সে জানতে পারে, কিছু যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে লঞ্চটি আটকে আছে। রেহানা, যাকে এই পরিস্থিতি খুব ভীত করে তুলেছিল, শান্তর দিকে তাকায়। তার চোখে ভয় আর উদ্বেগ স্পষ্ট। শান্ত তার হাত ধরে বলে,
"ভয় পেয়ো না। আমরা ঠিকই বাঁচব।"
এই মুহূর্তে, তাদের দুজনের মনের ভিতরে এক ধরনের আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। বিপদ যত বাড়তে থাকে, ততই তারা একে অপরের কাছে আসে। শান্ত প্রতিজ্ঞা করে যে সে রেহানাকে নিরাপদে রাখবে। কিন্তু সেই সময়েই নদীর পানি আরও উত্তাল হয়ে ওঠে। লঞ্চটি দুলতে থাকে। যাত্রীরা চিৎকার করে, অনেকে প্রার্থনায় বসে যায়। শান্ত সকলকে শান্ত থাকার জন্য অনুরোধ করে এবং লঞ্চের কর্মীদের সহযোগিতার চেষ্টা করে। সে বুঝতে পারে, তার দায়িত্ব কেবল নিজের নয়, বরং পুরো যাত্রীদের প্রতিও।
এই উত্তেজনাপূর্ণ সময়ে রেহানার কাছে এসে শান্ত বলে,
"তুমি কি ভয় পাচ্ছো?"
রেহানা এক মুহূর্ত শান্ত থাকে, তারপর বলে,
"ভয় পাইনি, কারণ আমি জানি, তুমি আছ।"
এই কথাটি তাদের দুজনের জন্য এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। কাঁপা নদী আর দুলতে থাকা লঞ্চের মধ্যে এই একটি মুহূর্তে তাদের সম্পর্কের শক্তি যেন অনেক বেশি দৃঢ় হয়।
অবশেষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। যান্ত্রিক ত্রুটি মেরামত হয়, এবং লঞ্চটি আবারও চলা শুরু করে। যাত্রীরা আনন্দে মুখর হয়ে ওঠে, কিন্তু শান্ত আর রেহানা নিজেদের মধ্যে এক নতুন সম্পর্কের সূচনা উপলব্ধি করে। বরিশালে পৌঁছানোর পর তাদের সম্পর্কের পথে আসে নতুন মোড়।
৪
শান্ত খান আর রেহানা একে অপরকে চিনত না, কিন্তু ভাগ্যের ইচ্ছেতেই তারা বরিশালগামী সম্ভ্রান্ত লঞ্চে একই যাত্রাপথে মিলিত হলো। শান্ত ছিল একজন উচ্চশিক্ষিত তরুণ, ঢাকায় একটি কর্পোরেট চাকরি করে; আর রেহানা একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, । ঝড়ের পরে তাদের প্রথম কথোপকথন শুরু। কথার ফাঁকে শান্ত জানল, রেহানা তার গ্রামের বিয়েতে যোগ দিতে যাচ্ছে। তারা গল্প করতে করতে আবিষ্কার করল, তাদের চিন্তাধারা, জীবনযাত্রা আর স্বপ্নের মধ্যে অবাক করা মিল। যাত্রাপথের অন্ধকারে ঝড় থেমে যাওয়ার পরও, তারা নিজেদের কথার মধ্যেই মগ্ন ছিল।
কিন্তু বরিশালে পৌঁছানোর পর, সবকিছু বদলে গেল। রেহানার পরিবার এই সম্পর্কের কথা জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। শান্ত যখন রেহানার বাড়িতে রেহানাকে ফিরিয়ে দিতে গিয়েছিল, তার বাবার ক্রোধে পরিবেশ যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল।
“তুমি কে? আমার মেয়েকে কেন এত রাতে নিয়ে এসেছো?” রেহানার বাবা চিৎকার করে উঠলেন।
শান্ত বোঝাতে চাইল, তারা কেবল বন্ধু হয়েছে। কিন্তু রেহানার পরিবারের দৃষ্টিতে, এটি ছিল অসম্ভব।
পরবর্তী কয়েকদিনে, পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠল। রেহানার পরিবারের চাপে শান্তকে বরিশালেই থাকতে হলো। এর মধ্যে রেহানার এক আত্মীয় গুজব ছড়াতে শুরু করল যে তারা পালিয়ে বিয়ে করেছে। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে রেহানার পরিবার বিপদগ্রস্ত বোধ করছিল। শান্তর পরিবারও সংবাদটি শুনে বরিশাল চলে এলো। শান্ত এবং রেহানার উপরে চাপ বাড়তে থাকল।
এই নাটকীয় অবস্থায়, শান্ত আর রেহানা এক রাতে দেখা করল। তারা জানত, তাদের সম্পর্ক এভাবে গোপনীয়তায় কুণ্ঠিত হয়ে থাকলে আরও অনেক বাধা আসবে। তারা সিদ্ধান্ত নিল, তাদের ভালবাসা সত্য হলে, তা সংগ্রামের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত। পরের দিন সকালে, তারা দুই পরিবারকে একত্রিত করল। শান্ত বলল,
“আমি কোনো ভুল করিনি। আমরা একে অপরকে জানার চেষ্টা করছি। যদি ভালোবাসা অপরাধ হয়, তবে আমি দোষী।” রেহানা তার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
দুই পরিবারের বিতর্ক তীব্র হলো, নগরীর ব্যস্ততার মাঝে শান্ত এবং রেহানার জীবনের পথ কিভাবে পাল্টে গেলো, তা ছিলো এক অসমাপ্ত ভালোবাসার কাব্য। ছোট্ট শহরে তাদের বেড়ে ওঠা, একে অপরকে জানা এবং একসময় গভীর ভালোবাসায় জড়িয়ে পড়া—এসব কিছুর মধ্য দিয়ে তাদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। তাদের মধুর স্মৃতিগুলো ছোটখাট বৃষ্টিস্নাত বিকেল থেকে শুরু করে শীতের কুয়াশা ভেদ করে একান্তে হাঁটা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।
কিন্তু সেই ভালোবাসার পথটি সহজ ছিল না। দুই পরিবারের সামাজিক অবস্থান, প্রথাগত নিয়মকানুন এবং বিশেষ করে সমাজের চোখ রাঙানি তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। শান্ত জানত, ভালোবাসা এত সহজে পাওয়া যায় না। তার মধ্যেও সেই দায়বদ্ধতা ছিলো যে, ভালোবাসাকে ধরে রাখার জন্য নিজের জায়গা শক্ত করতে হবে। সে ঢাকায় চাকরিতে যোগ দেয়ার জন্য চলে যায়, স্বপ্ন নিয়ে যে একদিন সে এবং রেহানা একসঙ্গে নতুন জীবন শুরু করবে। কিন্তু জীবন তো সবসময় স্বপ্নের পথে চলে না।
৫
রেহানার পরিবার তার ওপর চাপ দেয়, তাকে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি করাতে চেষ্টা চালায়। পরিস্থিতির চাপে সে যখন বুঝতে পারে যে পরিবারের চাওয়া এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে দাঁড়ানোর শক্তি তার নেই, তখনই সিদ্ধান্ত নেন নতুন বাস্তবতা গ্রহণ করার। রেহানা ঢাকায় তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকলেও, শান্তর সঙ্গে তার সব যোগাযোগ ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ হয়ে যায়।
শান্ত প্রতিদিন অফিস থেকে ফিরে রেহানার পুরনো বার্তাগুলো পড়ে, পুরনো স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু দিন যত যায়, বাস্তবতার কষাঘাতে তার ভেতরের স্বপ্নগুলো একে একে হারিয়ে যেতে থাকে। অন্যদিকে, রেহানা তার পড়াশোনা ও নতুন জীবন শুরু করলেও তার মনের গভীরে সেই পুরনো প্রেমের স্মৃতি তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িত করে।
৬
একদিন শান্ত এবং রেহানার পথ আবারো ঢাকা শহরের এক ব্যস্ত মোড়ে মিলে যায়। চোখের মিলন হয়, কিন্তু সেখানে আর সেই পুরনো আলোর ঝলক নেই। দুজনেই হয়তো বলতে চেয়েছিল কত কথা, কিন্তু সময় আর পরিস্থিতি সেদিকে কোনো সুযোগ দিলো না। দুজন আলাদা পথে হাঁটা শুরু করে, জানতো তাদের ভালোবাসার গল্প অপূর্ণ রয়ে গেল। হয়তো তাদের এই অসমাপ্ত গল্পই একদিন কারো কাছে কাব্য হয়ে ফিরে আসবে।
এই অসমাপ্ত গল্পের পেছনে থাকে ত্যাগ, পরিবারের চাপ, এবং সমাজের নিয়ম। শান্ত এবং রেহানা হয়তো একা ছিল না, তবে তারা তাদের ভালোবাসার পূর্ণতা দিতে পারেনি। তবুও তাদের ভালোবাসা চিরকালীন হয়ে থেকে গেল—অপূর্ণতা আর স্বপ্নের মতো।
৭
অতীত চিন্তা করতে করতে কখন যে দুপুরের খাবার সময় হয়ে গিয়েছে তা অফিস সহকারী ওবায়দুলের কথায় টের পাওয়া গেল,
“সার লাঞ্চ দেবো”
সম্বিত ফিরে এলো। এইতো জীবন এইতো সময়,বয়ে যাবে শেষ জীবনের দিকে শুধু রেখে যাবে কিছু স্মৃতি।
সমাপ্ত